পেট রাজনীতি বুঝে না

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম রীতিমতো ষড়যন্ত্র তত্ত্বই হাজির করেছেন। রাজনীতির সমবয়সী এ তত্ত্ব। বাংলাদেশে অতীতেও বহুবার একথা শোনা গেছে। যখনই কোনো সংকট তৈরি হয়, কেউ না কেউ এই তত্ত্ব হাজির করেন। বলাবাহুল্য, তাতে সবসময়ই রাজনীতিবিদরা এগিয়ে থাকেন।
চাল  নিয়ে দেশে এক নজিরবিহীন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অনেকেই একে ফখরুদ্দীন জমানার সঙ্গে তুলনা করছেন। ছায়া শাসনের সেই সময়ে সবচেয়ে বড় সংকট হিসেবে আবির্ভাব হয়েছিল, চালের দাম। মোটা চালের কেজি উঠেছিল ৪০ টাকায়। আর সরু চাল পৌঁছেছিল ৫৬ টাকায়। ওই মূল্য ছিল, বাংলাদেশের ইতিহাসে তখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। কিন্তু গত কয়েকদিনে সেই রেকর্ডও ভেঙে গেছে। বর্তমানে বাজারে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা কেজিতে। একটু ভালো সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। সরকারি হিসাব অনুযায়ীই গত এক মাসে সাধারণ মানের মোটা চালের দাম বেড়েছে আট শতাংশের বেশি। আর এক বছরে বেড়েছে প্রায় ৪৭ শতাংশ।
খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম অবশ্য এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পেছনে ঘড়যন্ত্র দেখছেন। তিনি বলেছেন, ‘ধানের উৎপাদন কম হওয়ার সুযোগ নিয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আর  মিল মালিক যোগসাজশের মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে হঠাৎ করে চালের দাম বৃদ্ধি করেছে।’ গণমাধ্যমকেও দুষেছেন মন্ত্রী কামরুল ইসলাম। অন্যদিকে, মিল মালিকরা বলছেন, দোষী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। বাংলাদেশে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দ্রব্যমূল্য বাড়ানো নতুন কোনো ঘটনা নয়। অসাধু ব্যবসায়ীরা সবসময়ই সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। সুযোগ এলেই জনগণের পকেট কাটেন তারা। এখন এই অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট যদি থেকেও থাকে, তা ভাঙার দায়িত্ব একান্তভাবেই সরকারের ওপর এসে পড়ে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দোষারূপের রাজনীতি করে খাদ্যমন্ত্রী দায় এড়াতে পারেন না।
চাল নিয়ে রাজনীতির দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে বাংলাদেশে। চাল আর রাজনীতি খুব বেশি দূরের কিছু নয়। এদেশে সবসময়ই চালের দামকে স্পর্শকাতর ইস্যু মনে করা হয়। ভোটের রাজনীতিতেও চাল গুরুত্বপূর্ণ। ‘১০ টাকা কেজি চাল’ নিয়ে বহু বাতচিত হয়েছে। এমন ওয়াদা করা হয়েছিল, নাকি হয়নি তা নিয়ে বিতর্ক চলে আসছে। তবে চালের বর্তমান উচ্চমূল্যে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তের মানুষেরা। পেটতো আর রাজনীতি বুঝে না। উচ্চমূল্যে চাল কিনতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন মানুষ। ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে বাজেট। এমনকি পত্রিকায় এও খবর বেরিয়েছে, চালের উচ্চ মূল্যের কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ ভাত খাওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। ৪-৫ সদস্যের ছোট একটি পরিবারে কেবল চালের পেছনেই খরচ বেড়েছে প্রায় পাঁচশ’ টাকা। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং বেসরকারি সংস্থা পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, চাল এখনো খাদ্যতালিকার প্রধান খাদ্য। এর দাম বাড়লে নিম্ন আয়ের মানুষ দৈনিক খাদ্যের পরিমাণ ঠিক রাখতে গিয়ে অন্যান্য খরচ কমিয়ে ফেলেন। অথবা অনেক সময় দেনাও করতে হয়। ফলে চালের দাম বাড়লে অবধারিতভাবে একটা প্রভাব পড়ে, সেটা কষ্টের। তিনি বলেন, বোরো ধান আসার পরও চালের দাম না কমা একটা আশঙ্কার বিষয়। খাদ্য মজুতও সর্বনিম্ন পর্যায়ে। এটা যে বড় ধরনের একটি সংকট সেই উপলব্ধি মাথায় নিয়ে মাঠে নামা জরুরি, যাতে এটা মহাসংকটে পরিণত না হয়।
ঢাকার বাবুবাজার আড়তে চালের বস্তা টেনে জীবিকা চালান রাসেল মিয়া। ৪৮ টাকা কেজিতে চাল কিনে খান তিনি। বিবিসি বাংলাকে রাসেল বলছিলেন, ‘আমাদের মনে করেন প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন কেজি চাউল লাগে। বর্তমানে আমরা রুজি করি ধরেন তিন থেকে চাইর শ’ ট্যাকা। চাউলেই যদি আমাদের ধরেন দুইশ’ টাকা যায় গা তাইলে বাজারের ট্যাকা থাকে কইথিথকা?।’ রাসেল একা নন, চালের রেকর্ড দামে একই অবস্থা খেটে খাওয়া সব মানুষেরই। ওদিকে, দেশে চাল ও গমের মজুত এখন স্মরণকালের সর্বনিম্ন পর্যায়ে রয়েছে। গত ২৫শে মে’র খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী চালের মজুত দুই লাখ ২৪ হাজার টন ও গমের মজুত দুই লাখ ৭৫ হাজার টন। সব মিলিয়ে চার লাখ ৯৯ হাজার টন খাদ্যশস্য সরকারি গুদামে মজুত রয়েছে। এই অবস্থায় চাল রপ্তানি করে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করছে সরকার।
আগেই বলা হয়েছে, পেট রাজনীতি বুঝে না। ক্ষুধার কোনো রাজনীতি নেই। পক্ষ-বিপক্ষ নেই। আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেই। অর্থনীতিবিদরা এরইমধ্যে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। বলেছেন, এখনই পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। না হলে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে। বিপদ বাড়বে সাধারণ মানুষের।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর